অনলাইন বেটিং আসক্তি: জুয়া যেভাবে মানুষের ব্রেইন‌ওয়াশ করে

আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। ট্রিকবিডির ভিজিটরদের সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছি এই প্ল্যাটফর্মে।

আজকে আমি কথা বলতে চলেছি অনলাইন গ্যাম্বলিং,ক্রিকেট বেটিং সহ যাবতীয় অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইট গুলো নিয়ে। বর্তমানে‌ আমাদের সমাজে অনলাইন জুয়া খুবই ভয়‌ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।‌ এটি অনেকটা নীরব ঘাতকের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় অনেকে না জেনে বুঝে কিংবা কৌতুহলের কারনে এখানে পা রাখে, পরে আর বের হতে পারে‌না।

আজকে আমি সম্পূর্ণভাবে ব্রেকডাউন করতে চলেছি কিভাবে অনলাইন বেটিং দ্রুত আপনার মাইন্ডসেট ভয়ংকরভাবে প্রবাহিত বা ম্যানিপুলেট করে

১.দ্রূত বড়লোক হ‌ওয়ার স্ট্র্যাজেডি মাইন্ডসেট


বাংলাদেশের জনসাধারনের কথা বলতে গেলে বেশিরভাগই দরিদ্র এবং নিন্ম-মধ্যবিত্ত‌ শ্রেনীর। তবে‌ সমাজে চলতে গেলে সকল শ্রেনীর মানুষজন‌ই আছে। একটা বিষয় হয়তো খেয়াল করবেন যারা‌ রিচ ফ্যামিলি থেকে বড় হয় কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে থাকে তারা একটা খুবই বড় ধরনের প্রিভিলেজ পায়।তাদের সাধারনত টাকা পয়সা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। এবং খেয়াল করলেই দেখবেন তাদের একটা বড় অংশ সবার আগে বাইক,দামী মোবাইল, লেটেস্ট ফ্যাশন‌ ইত্যাদি ব্যবহার করার সুযোগটুকু পায়।

যারা দরিদ্র এবং তুলনামূলক অস্বচ্ছল পরিবারে বড় হয় তাদের বেশিরভাগ যারা অনলাইন‌ জুয়ায় আসে তাদের মাঝে এই মাইন্ডসেটটুকু থাকে যে খুব কম‌ই খেলব কিংবা শুধুমাত্র নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য খেলব।অনেকের মাঝে টার্গেট থাকে যে একটা দামী মোবাইল কেনার টাকা কিংবা বাইক কিনার টাকা উঠে গেলেই তারা জুয়া বন্ধ‌ করে দেবে।


২.সিউর আন্দাজ মনোভাব


অনলাইন বেটিং সাইট সাধারনত ক্রিকেট ফুটবল ইত্যাদির উপর জুয়া ধরার অপশন খুলে দেয়। এখন আমাদের হিউম্যান সাইকোলজির বৈশিষ্ট্য‌ই হচ্ছে ধরে নেয়া যে দল বেশি শক্তিশালী কিংবা র্য্যাংকিং এ এগিয়ে আসে তারাই জিতবে।‌ কিন্তু খেলায় জয় শুধুমাত্র শক্তিশালী দলের উপরেই নির্ভর করে না। এখানে বিভিন্ন ফ্যাক্টর কাজ করে। খেলোয়াড়েরা তাদের ফর্মে আছে কিনা, মাঠের কন্ডিশন কেমন, আবহাওয়া,খেলার কোচদের নতুন স্ট্র্যাজেডি এসব খুবই প্রভাব ফেলে দলে।কিন্তু হিউম্যান‌ সাইকোলজির কারনে জুয়ারিদের একটা বড় অংশ‌ ধরে নেয় যেটি বড় দল‌ তারাই জিতবে। বেটিং ওয়েবসাইটেও এমনভাবে odd থাকে যেন তাদের মাইন্ডসেটকে আরো প্রভাবিত করে দুই দলের মধ্যে বড় দলের উপর বাজি ধরতে।
কারন বেটিং ওয়েবসাইট এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন বড় দলের odd কম থাকে এবং ছোটদলের odd বেশি। সাইকোলজিক্যালি বোঝানো হয় যে ছোট দলের odd বেশি মানে সেটি অনেক দূর্বল‌ দল।
( Odd হচ্ছে আপনি কত গুন টাকা লাভ করবেন)
এভাবে জুয়ারিরা বাজি লাগায়। কিন্তু খেলায় শুধু বড় দল‌ই জিতে না। জুয়ারিদের আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে এবার জিতে নাই পরের ম্যাচ জিতবে। ফলে‌ তারা আরো বেশি পরিমান টাকা বাজি ধরে কিন্তু এর পরের ম্যাচ‌ও যদি না জিতে তাহলে তাদের বাজির টাকা সম্পূর্ন চলে‌ যায়।


৩.Lucky day ও loss cover মাইন্ডসেট

জুয়ারিদের বাজি হারার পর মাথায় আসে একটুর জন্য ম্যাচ হারল। হয়তো এর পরেরবারে জিতে যেতে পারি। এই মানসিকতার জন্য দিনে দিনে তাদের বাজি ধরার টাকার পরিমান বাড়তে থাকে। অতপর হঠাৎ একদিন বাজির দল হেরে যায়। সেই সাথে লস পরে যায় তাদের‌ সকল টাকা।
টাকা লস করার পর তাদের বোধোদয় হয় যে জুয়ার পিছনে অনেক টাকা গেছে। এই টাকা লস কভার করতে হবে। ফলে বিগত লস করা টাকা তুলার জন্য তারা আবার জুয়ার টাকা রিচার্জ করে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। কারো লস করা টাকার পরিমাধ পোছায় ৫-৬ হাজার কারোরবা লাখখানেক টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা লস করার জন্য তারা আবার জুয়া ধরে। প্রথম দুই-তিন ম্যাচ জেতার পর তাদের লোভ বৃদ্ধি পায়। বড় ধরনের বাজির টাকা তারা আবার বেট ধরে কিন্তু যদি হেরে যায় তাদের লস কভার করা দূরের কথা আরো বেশি লসের পাল্লা ভারী হয়ে ওঠে।

এসব আলোচনা করলাম প্রি-বেটিং মাইন্ডসেট। এবার বলছি স্টেজ টু স্টেজ জুয়ারিদের অবস্থা

১.প্রাথমিক স্টেজ

এটি মূলত শুরু হয় নিজের টাকা দিয়ে বাজি খেলার পর।যখন তারা হারে তারা ভাবে যে একটুর জন্য জেতা বাজি হারলাম। ফলে তারা সুযোগে থেকে কখন আবার জুয়ার একটা এমাউন্ট যোগার করতে পারে।

২.স্টেজ দুই

এটি হচ্ছে বাজি ধরার পর মানসিকতার পরিবর্তন। তাদের মাঝে প্রচন্ড টেনশন কাজ করে কখন খেলা শেষ হবে কখন রেজাল্ট হাতে পাবে। এ পর্যায়ে তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়।তারা ভালোভাবে চিন্তা করতে পারে না, তাদের চিন্তাভাবনা ঘোলাটে হয়ে যায়। এর সঙ্গে বাড়তে থাকে টেনশন, ব্লাড প্রেসার,রাতের পর রাতজাগার অভ্যাস।

বাজি হেরে গেলে শুরু হয় পরিবার, বন্ধুবান্ধব থেকে টাকা খোঁজা, লোন‌ নেওয়া। তাদের ভাবনায় থাকে বাজি কোনরকম জিতে গেলেই তাদের টাকা শোধ করা যাবে

৩.স্টেজ তিন

জুয়া সর্বগ্রাসী এটি জুয়ায় আসক্তরা খুবই দেরীতে বুঝতে পারে। এ পর্যায়ে শুরু হয় লস কভারের মিশন।লস কভারের টাকা উঠাতে তারা শুরূ করে আরো জুয়া খেলা। ইতোমধ্যে পরিবারের সম্পর্কের ফাটল ধরে টাকা নিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে শুরু হয় তর্ক ঝগড়া। কিন্তু হারা জুয়ার টাকা তুলতে হবে যে!
শুরু হয় অপরাধের জগতে বিচরন। জুয়ার টাকা তুলতে বেছে নেয় চুরি,ছিনতাই,সম্পত্তি বিক্রির মতো কাজ।

৪.স্টেজ চার

এ পর্যায়ে জুয়ারিদের যা সর্বনাশ হ‌ওয়ার হয়ে গেছে। টাকা শূন্য রিক্ত হস্তে তাদের বেদনার দিন‌ শুরু হয়। সেই সাথে বাড়ে পাওনাদারদের তাগাদা। ততদিনে পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। তাদের অনুশোচনা জাগে এ কি করলাম!
তারা হয়ে পড়ে একা, নিঃসঙ্গ। কেউ তার সাথে আর থাকতে চায় না, সম্পর্ক রাখতে চায় না। এ পর্যায়ে ডিপ্রেশনে পড়ে অনেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো কাজ

জুয়া একটি ভয়ংকর নেশা।সবার উচিত এর থেকে দূরে থাকা।এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? এ‌ নিয়ে আমি স্পেসিফিকভাবে কয়েকটি বিষয় পয়েন্ট‌আউট করছি

১.কৌতুহলবশত জুয়া খেলা যাবে না। এ ব্যাপারে কোন প্রচার‌ই করা যাবে না। কারন মানুষ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষিত হয় বেশি।

২.জুয়ায় যদি টাকা লস করেই ফেলেছেন তাহলে আপনার উচিত লস কভার এর চেষ্টা না করা। লস কভার একটি মরনব্যাধী লুপ। এ গিট থেকে বের হতে গিয়ে জুয়ারীরা আরো বেশি টাকা লস করে ফেলে

৩.ইতোমধ্যে জুয়ায় জড়ালে আপনার উচিত যতদ্রুত সম্ভব জুয়ার অ্যাপ ওয়েবসাইট ব্লক করা। একাউন্টে ইচ্ছেমতো আন্দাজে পাসওয়ার্ড বসিয়ে জুয়ার একাউন্ট ডিলেট করা। কারন এখানে কবে কখন ভয়ংকরভাবে আসক্ত হয়ে যাবেন তার কোন সঠিক টাইম নাই।এক‌ইসাথে রিয়ালাইজ করতে হবে জুয়া শুধুই সর্বগ্রাসী ছোবল ছাড়া কিছু নয়।


দিনশেষে নিজের সুখে থাকাই বড় কথা।‌ টাকা সুখ এনে দিতে পারে কিন্তু জুয়ায় কখনো আপনি টাকা কামাতে পারবেন না। নিজেকে ভালোবাসুন। জুয়ায় অলরেডি জড়িয়ে পড়লে ছেড়ে দিন এই ভয়ংকর অভ্যাস। নিজের পছন্দের মানুষদের কথা ভাবুন।‌নাই বা হলো আপনার দামী গাড়ি কিংবা দামী ফোনের ব্যবহার। কিন্তু অন্ততপক্ষে আপনি ভালো থাকবেন। সমাজের ধিক্কারের কারন হবেন না।

আজ‌ এই পর্যন্ত‌ই। আল্লাহ আমাদের এই পাপকাজ থেকে হেফাজত করূক। আমীন।

The post অনলাইন বেটিং আসক্তি: জুয়া যেভাবে মানুষের ব্রেইন‌ওয়াশ করে appeared first on Trickbd.com.



from Trickbd.com https://ift.tt/hMm6SPu
via IFTTT

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট