আসসালামু আলাইকুম,
প্রায় অনেকদিন পর ট্রিকবিডিতে লিখতে বসলাম। করোনার সময় বাড়িতে বসে বসে আলসেমিটা চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বটে। এই আলসেমি দূর করার জন্য শুরু করেছিলাম বিভিন্ন ব্যতিক্রমধর্মী মুভি এবং টিভি সিরিজ দেখা। দূর্ভাগ্যবশত করোনার পরে সবকিছু স্বাভাবিক হলেও আমার টিভি সিরিজ এবং মুভি দেখাটা রীতিমতো নেশায় পরিনত হয়েছে। এমন কোনো দিন নাই যে দিন ২-৩ টা মুভি কিংবা কোনো একটা সিরিজের ফুল সিজন শেষ করিনি। তো যাই হোক চলে আসি আজকে টপিকে।
বর্তমান সময়ে পুরো বিশ্বজুড়ে কোরিয়ার মুভির জনপ্রিয়তা বেশ তুঙ্গে রয়েছে। কারণ হিসেবে দেখানো যেতে পারে তাদের অসাধারণ গল্প এবং সেই সাথে অভিনয়-শিল্পীদের মন মাতানো অভিনয়। যার প্রমাণস্বরূপ তাদের বক্স-অফিস কাপানো মুভিগুলোকে দেখানো যেতে পারে যার মাধ্যমে তারা বিশ্বের বড় বড় এওয়ার্ডগুলো তাদের ঝুলিতে নিয়ে নিচ্ছে।
তো এইক্ষেত্রে আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশও কিন্তু পিছিয়ে নেই। কোরিয়ান সিরিজ কিংবা মুভির প্রচুর হাইপ উঠেছে দেশের প্রতিটি মুভি/সিরিজ লাভারদের মনে। বিশেষ করে আমাদের টিনেজারদের মধ্যে বেশিরভাগই কোরিয়ান মুভির প্রতি প্রচুর আকৃষ্ট। তো এমত অবস্থায় আমার নিকটতম এক বন্ধু হুট করে আমাকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী একটা মুভির কথা বলল এবং সেই সাথে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল যে মুভির রিভিউটা করতে কারণ আমি এর আগে কখনো ঘটা করে কোনো মুভির রিভিউ করিনি বা আদৌ কোরিয়ান কোনো মুভিই দেখিই নি। যদিও তাকে পারসোনালি আমি মুভি সম্পর্কে দু-এক লাইনের রিভিউ দিয়েছিলাম কিন্তু তার সন্তুষ্টি অর্জন করা বেশ দূর্ষহ হয়ে পড়েছে। তো আজকের মুভির রিভিউটা তাকে ডেডিকেটেক করে লেখা ।
মুভির নামঃ প্যারাসাইট(২০১৯)
দেশঃ দক্ষিণ কোরিয়া
ডিরেক্টরঃ বং জুন হু
আইএমডিবিঃ ৮.৫
বাজেটঃ ১৫.৫ মিলিয়ন ডলার
বক্স অফিসঃ ২৬৩.১ মিলিয়ন ডলার
প্রফিটঃ ২৪৭.৬ মিলিয়ন ডলার(বাজেটের ১৬ গুন)
এওয়ার্ডঃ ১৯৭ টি (৪ টি অস্কার)
রিভিউটি লেখার আগে দুইজন মহান ব্যক্তিত্বের উক্তির কথা উল্লেখ না করলেই নয় যাদের দর্শনের উপর নির্ভর করে আজকের মুভিটি সম্পর্কে আমার ধারণা ব্যক্ত করব।
সমাজের উৎপত্তি সম্পর্কে গুরু কার্ল মার্কস বলেছিলেন যে, “শ্রেনি ভিত্তিক সমাজের উৎপত্তি হয়েছিল মূলত দাস সমাজ থেকে যা পরবর্তীতে বিকশিত হতে হতে পুজিঁবাদী সমাজে রূপ নেয় যেখানে বৈষম্য বেড়েই চলেছে”।
আর তারই পথে হেটে “পার্সি শেলি” সেই বিখ্যাত কথাটি বলেছিলেন যে, “The rich get richer and the poor get poorer”.
অনেক বকবক করা হল, এবার মুভির গল্পটাতে চলে যাইঃ
তো মুভিটির শুরুতে দেখানো হয় একটি নিম্নবিত্ত পরিবারকে(কিম পরিবার) যেখানে কি-তাক, তার স্ত্রী চুং-সুক, ছেলে কি-উ ও মেয়ে কি-জোং কে নিয়ে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড এপার্টমেন্টে থাকেন যেখানের আশেপাশে ময়লা আবর্জনা ভর্তি এবং অনেক সময় মাতাল লোকগুলো সেখানের পাশে এসে প্রসাব করে দেয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তাদের ভাল কোনো জায়গায় থাকার সামর্থ্য নেই কারণ যোগ্যতা থাকার সত্ত্বেও তারা ৪ জনই বেকার। কাজ বলতে পিজ্জা বক্স বানিয়ে কোনোমতে নিজেদের দিন যাপন করে।
তাদের এই খারাপ সময়ে হঠাৎ একদিন কি-উ এর বন্ধু তাদের বাসায় আসে এবং তার পরিবর্তে কি-উ কে একটা টিউশনি করানো জন্য বলে কারণ তার বন্ধুটি বিদেশ চলে যাবে। আর টিউশনিটা ছিল বিশাল এক ধনাঢ্য পরিবার “পার্ক পরিবারে”।
পার্ক পরিবারটির সদস্য ছিল ৪ জন। পার্ক ডং-ইক তার স্ত্রী পার্ক ইওন-জিও, হাইস্কুলে পড়ুয়া মেয়ে দা-হিয়ে ও ছোট্ট ছেলে দা-সং কে নিয়ে পার্ক ফ্যামিলির সু-বিশাল বাড়িতে থাকেন। সেই সাথে পার্ক ফ্যামিলির গৃহ-পরিচালিকা হিসেবে দেখা যাবে গোয়াং কে যিনি বেশ অভিজ্ঞ এবং পার্ক ফ্যামিলির আগে যে ফ্যামিলিটি সু-বিশাল বাড়িটিতে থাকত তাদেরও গৃহ-পরিচালিকা হিসেবে ছিলেন গোয়াং।
তো কি-উ তার বন্ধুর বদৌলতে দা-হিয়ের টিউটরের চাকুরিটি পাওয়ার পর এটা আবিষ্কার করে যে দা-হিয়ের মা পার্ক ইওন-জিও বেশ সহজ-সরল এবং সেই সাথে নিজের ছোট্ট ছেলে দা-সং এর বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তো সে এই সুযোগটি কাজে লাগায় এবং নিজের বোন কি-জোং কে বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেয় যে সে নাকি অনেক বড় ডিগ্রিধারী আর্টিস্ট।
তো এভাবে দা-সংয়ের আর্ট টিউটর হিসেবে কি-জোং রাখার পর কি-জোং কৌশলে ইওন-জিও কে বোঝায় যে দা-সং মানসিকভাবে স্টেবল না এবং তার আর্ট থেরাপি প্রয়োজন। এভাবে তারা দুই ভাই-বোন ধীরে ধীরে সেই পার্ক ফ্যামিলির বিশ্বস্ত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে এই বিশ্বস্ততার সুযোগ নিয়ে কৌশলে তারা ড্রাইভার এবং বিশ্বস্ত গৃহ-পরিচালিকা গোয়াং কে চাকরিচ্যুত করে এবং তাদের জায়গায় তাদের বাবাকে ড্রাইভার এবং মাকে গৃহ-পরিচালিকা হিসেবে পার্ক ফ্যামিলিতে নিয়ে আসে।
এখান পর্যন্ত আপনাদের মুভিটি অনেক মজাদার লাগবে কারণ এই পর্যন্ত আপনারা দেখবেন একটি অসহায় নিম্নবিত্ত ফ্যামিলি কিভাবে ভাল একটা পজিশনে উঠে আসে এবং তাদের প্রতিটি কার্যকলাপ দেখে আপনার মনের ভেতরে একটাই শব্দ ভেসে আসবে আর সেটা হল, “জিনিয়াস!!”
তো কমেডি, জিনিয়াসগিরি তো অনেক মুভিতেই দেখা যায় কিন্তু এই মুভিতে এমন কি আছে যার জন্য ১৯৭ টা এওয়ার্ড পেয়েছে মুভিটা যার মধ্যে ৪ টা অস্কারও রয়েছে!! কারণ এই অবধি কাহিনীর জন্য তো আর এটাকে আর্টের লেভেলে নিয়ে যাওয়া যায় না আর এত্তগুলা এওয়ার্ডও দেয়া যায় না! তবে কাহিনী কী???
তথাকথিত ফ্যামিলি ড্রামা আর কমেডির পর্ব শেষে কাহিনী মূলত শুরু হয় এখান থেকে যা দেখে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যেতে বাধ্য! এর পরে থেকে কখন কি হবে সেটা আপনি আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন কিন্তু দিন শেষে দেখবেন আপনি ভুল! মানে আমার নিজের মাথাই প্রায় ঘুরে গিয়েছিল পরবর্তী অংশ দেখার পরে। বুঝতে পারছিলাম না আদৌ মুভিটা কোন ক্যাটাগরিতে পড়েছে কিংবা আদৌ ডিরেক্টর কি বুঝাতে চাচ্ছে মুভিটা দিয়ে।
তো কাহিনীতে টুইস্ট আসে পার্ক পরিবারের সকল সদস্যদের কোনো এক জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার পরে। তারা গৃহ-পরিচালিকা অর্থাৎ চুং-সুক কে রেখে সবাই চলে যায় জন্মদিনের পার্টিতে এবং বলে যে আজকে আর ফিরবে না। তো পার্ক ফ্যামিলির বাড়িটি সম্পূর্ণ খালি থাকে যার ফলে অন্তত একটা দিন আলিশান বাড়িতে কাটানোর সুযোগ মিস না করার জন্য পুরো কিম ফ্যামিলি বাড়িটাতে চলে আসে। তারা এমনভাবে উপভোগ করতে থাকে যেন বাড়িটা তাদের নিজেরই। তারা নিজেদের মধ্যে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠেছিল, এমন সময় শোনা গেল কলিং বেলের আওয়াজ যা পাল্টে দিল কিম এবং পার্ক পরিবারের জীবন!!
ছবিঃ কিম পরিবার পার্ক ম্যানশনে
মুভিটিকে কি কি শব্দে বর্ণনা করব বুঝতে পারছি না। এটার অভিনব কাহিনী, অসাধারণ স্ক্রিনপ্লে আর চরম বাস্তবতাকে তুলে ধরার অবস্থা দেখে মনে হবে, “আরেহ! এটা তো আমার আশেপাশেই হচ্ছে, এভাবে তো ভেবে দেখিনি!”।
ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বদের জন্য দরিদ্ররা কতটা অবহেলা এবং হাসির পাত্র তা বলে বোঝানো সম্ভব না যেটা মুভিতে তুলে ধরেছেন ডিরেক্টর। সমাজের যে অসম অবস্থা সম্পর্কে কার্ল মার্কস বলেছেন তার বাস্তব রূপ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তুলে ধরেছেন কোরিয়ান নির্মাতা। এছাড়া কিম ফ্যামিলি তাদের অভাবের তাড়নায় ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মিথ্যাচার এবং ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। যদিও তাদের না চাইতেও এটা করতে হয়েছে শুধুমাত্র একটু ভাল থাকার আশায়। শুধু তাই না, এই সামাজিক অসমতা, উঁচু-নিচু মানসিকতার কারণে যে মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে হারিয়ে পশুতে পরিণত হয় এবং দানব রূপ ধারণ করে তার একটা উদাহরণ হতে পারে এই মুভিটি।
সম্পূর্ণ মুভিটি mlwbd তে খুজে পাবেন
তো আজকের মত এতটুকুই। আমি মুভি রিভিউ করিনি কখনও কিন্তু ট্রিকবিডিতে অনেকে আছেন যারা নিয়মিত মুভি নিয়ে লেখালেখি করেন। লেখালেখি না করলেও সবার পোস্টই আমি নিয়মিত পড়ি। আমার ভুলত্রুটি থাকতেই পারে কারণ আমি মানুষ, ফেরেশতা নই। তাই লেখাটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে পড়বেন।
সব সময় ট্রিকবিডির সাথেই থাকুন।
যেকোনো প্রয়োজনে ফেসবুকে যোগাযোগ করুন
The post Parasite (2019) ৪ টা অস্কারসহ মোট ১৯৭ টি এওয়ার্ড প্রাপ্ত মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত কোরিয়ান মুভি; Reviewed by Tajul Islam appeared first on Trickbd.com.
from Trickbd.com https://ift.tt/JSy0PxA
via IFTTT